বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীতে প্রায় ৮৭ লক্ষ ভিন্ন ভিন্ন রকমের জীব রয়েছে। বৈচিত্র্যময় এই জীবকূলকে সহজভাবে জানার জন্য বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর সমস্ত জীবকে তাদের বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধকরণের চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৯ খ্রী. বিজ্ঞানী হুইটেকার পঞ্চরাজ্য শ্রেণিবিন্যাস প্রবর্তন করেন। ১৯৭৪ খ্রি. বিজ্ঞানী মাগিউলিস (Margulis) উক্ত শ্রেণিবিন্যাসকে পুনর্বিন্যাস করে জীবজগতের আধুনিক শ্রেণিবিন্যাস প্রবর্তন করেন। আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসটি নিম্নরূপ:

রাজ্য-১: মনেরা : এ রাজ্যের অধীনে বিন্যস্ত জীবের বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: ক) জীবটি এককোষী এবং এর কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে না খ) এরা খুবই ক্ষুদ্র এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এদের দেখা যায় না। উদাহরণ: ব্যাকটেরিয়া, সায়ানোব্যাকটেরিয়া, স্পাইরোগাইরা ইত্যাদি।
রাজ্য-২: প্রোটিস্টা: এর অধীনে ঐ সকল জীবকে বিন্যস্ত করা হয়, যাদের কোষ সুগঠিত নিউক্লিয়াসযুক্ত এরা এককোষী বা বহুকোষী ক্লোরোফিল যুক্ত একক বা দলবদ্ধভাবে থাকতে পারে। উদাহরণ: ইউগ্লেনা, অ্যামিবা ইত্যাদি।
রাজ্য-৩: ফানজাই বা ছত্রাক: এদের দেহে সুগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে। এরা সাধারণত এককোষী বা বহুকোষী হয়। দেহে ক্লোরোফিল নেই, তাই এরা পরভোজী। উদাহরণ- ইস্ট, পেনিসিলিয়াম, মাশরুম ইত্যাদি।
রাজ্য- ৪: প্লান্টি (উদ্ভিদজগৎ): অধিকাংশ উদ্ভিদ নিজেই নিজের খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে। এদের দেহ
অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। এদের কোষপ্রাচীর সেলুলোজ দ্বারা নির্মিত। এদের কোষে সুগঠিত নিউক্লিয়াস ও কোষ গহ্বর বিদ্যমান। উদ্ভিদে সবুজ কণিকা বা ক্লোরোফিল থাকে, তাই এরা খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে। উদাহরণ: আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি।
সুবিশাল উদ্ভিদজগৎকে তাদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে আবার নানা ভাগে বিভক্ত করা যায় জর্জ বেনথাম ও ডাল্টন হুকার এর প্রাকৃতিক শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী উদ্ভিদ জগৎকে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

অপুষ্পক উদ্ভিদ
যেসব উদ্ভিদে ফুল, ফল ও বীজ উৎপন্ন হয় না তাদেরকে অপুষ্পক উদ্ভিদ বলে। যেমন: মস, ফার্ণ ইত্যাদি। এরা স্পোর বা রেনুর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে থাকে। অপুষ্পক উদ্ভিদকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
সমাঙ্গবর্গীয় উদ্ভিদ: এসব উদ্ভিদের দেহ মূল, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত করা যায় না। এদের মধ্যে যাদের ক্লোরোফিল আছে, ফলে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে তারা শৈবাল। যেমন: স্পাইরোগাইরা। আর যাদের দেহে ক্লোরোফিল নেই, ফলে নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না, তারা ছত্রাক। যেমন: এগারিকাস।

মসবর্গীয় উদ্ভিদ: এদের দেহ কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত করা যায়। কিন্তু এদের মূল নেই, মূলের পরিবর্তে রাইজয়েড নামক সূত্রাকার অঙ্গ থাকে। সাধারণত এরা পুরানো ভেজা দেয়ালে কার্পেটের মতো নরম আস্তরণ করে জন্মায়। যেমন: ব্রায়াম।
ফার্নবর্গীয় উদ্ভিদ: ফার্নবর্গীয় উদ্ভিদের দেহ মূল, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত। এদের দেহে পরিবহণ টিস্যু রয়েছে ও কচি পাতাগুলো কুণ্ডলীত থাকে। বাড়ির পাশে স্যাতস্যাতে ছায়াযুক্ত স্থানে এবং পুরানো দালানের প্রাচীরে এদের জন্মাতে দেখা যায়। যেমন: টেরিস।

| কাজ: ঢেঁকিশাক, লালশাক, লাউশাক, গম, সরিষা ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনো এবং কোনটি ফার্ন নয় তা খাতায় লিখ। |
সপুষ্পক উদ্ভিদ
উদ্ভিদে ফুলের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে উদ্ভিদকে সপুষ্পক ও অপুষ্পক এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। যেসব উদ্ভিদে ফুল উৎপন্ন হয় তাদেরকে সপুষ্পক উদ্ভিদ বলে। যেমন: আম, কাঁঠাল, ধান, নারিকেল ইত্যাদি। এদের দেহ সুস্পষ্টভাবে মূল, কাণ্ড এবং পাতা বিভক্ত। ফুলের মাধ্যমে পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় এদের বংশবিস্তার ঘটে। বীজের আবরণের উপর নির্ভর করে সপুষ্পক উদ্ভিদকে আবার নগ্নবীজী এবং আবৃতবীজী এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়। নগ্নবীজী উদ্ভিদের ফুলে গর্ভাশয় থাকে না বলে ফল উৎপন্ন হয় না। তাই বীজ নগ্ন অবস্থায় থাকে। উদাহরণ: সাইকাস, পাইনাস ইত্যাদি। আর আবৃতবীজী উদ্ভিদের ফুলে গর্ভাশয় থাকায় ফল উৎপাদন হয় এবং বীজ আবৃত থাকে। উদাহরণ: আম, জাম, সুপারি ইত্যাদি।

এদের দেহ তিনটি অংশে বিভক্ত যথা: মস্তক, বক্ষ ও উদর। এদের সন্ধিযুক্ত পা ও পুঞ্জাক্ষি থাকে। অনেক পতঙ্গ আমাদের উপকার করে। এরা উপকারী পতঙ্গ। যেমন: মৌমাছি, রেশম পোকা ইত্যাদি। মশা ও মাছি নানা রকম রোগ ছড়ায়। অনেক পতঙ্গ আবার আমাদের ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র ও ফসলের ক্ষতিসাধন করে যেমন: উইপোকা, লেদাপোকা, পামরীপোকা ইত্যাদি। এমন কতকগুলো সামুদ্রিক প্রাণী আছে, যাদের ত্বকে কাঁটার মতো অংশ থাকে। তারামাছ ও সামুদ্রিক শশা এই দলভুক্ত প্রাণী। জেলী মাছ, প্রবালকীট আরেক দলভুক্ত অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এদের দেহের ভিতর একটা ফাঁপা গহ্বর বা সিলেন্টেরন থাকে। এদের দেহে একটি মাত্র ছিদ্র থাকে। এই ছিদ্রপথে এরা খাদ্য গ্রহণ করে আবার বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়।
মেরুদণ্ডী প্রাণী:
এদের মেরুদণ্ড আছে। দেহের ভিতর কঙ্কাল থাকে। পাখনা বা দুই জোড়া পা থাকে। চোখ সরল প্রকৃতির। মানুষ ছাড়া সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীর লেজ থাকে। এরা ফুলকা বা ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। মেরুদণ্ডী প্রাণীদের বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। সকল মাছ মৎস্য শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। এরা পানিতে বাস করে। বেশির ভাগ মাছের গায়ে আঁইশ থাকে। যেমন- ইলিশ, রুই, কৈ ইত্যাদি। আবার কতকগুলোর আঁইশ থাকে না। যেমন- মাগুর, শিং, টেংরা, বোয়াল ইত্যাদি। মাছ ফুলকার সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়। এদের পাখনা আছে, পাখনার সাহায্যে এরা সাঁতার কাঁটে।




ব্যাঙ উভচর শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। এদের জীবনের কিছু সময় ডাঙায় ও কিছু সময় পানিতে বাস করে। এদের ত্বকে লোম, আঁইশ বা পালক কিছুই থাকে না। দুই জোড়া পা থাকে, পায়ের আঙুলে কোনো নখ থাকে না। ব্যাঙাচি অবস্থায় এরা ফুলকা ও পরিণত অবস্থায় ফুসফুসের সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়।
টিকটিকি, কুমির, সাপ, গিরগিটি ইত্যাদি সরীসৃপ শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। এরা বুকে ভর দিয়ে চলে, আঙুলে নখ থাকে, ডিম পাড়ে, ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। ফুসফসের সাহায্যে শ্বাসকার্য চালায়।
হাঁস, মুরগি, কবুতর, দোয়েল ইত্যাদি পাখি পক্ষী শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। এদের দেহ পালক দিয়ে আবৃত থাকে। পালক পাখি চেনার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাখি ছাড়া আর কোনো প্রাণীর পালক নেই। বেশিরভাগ পাখিই আছে যারা উড়তে পারে। উট পাখি, পেঙ্গুইন এবং আরও কিছু পাখি আছে যারা উড়তে পারে না। পাখি ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা হয়।
বানর, ইঁদুর, কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল ইত্যাদি স্তন্যপায়ী শ্রেণিভুক্ত প্রাণী। মানুষও এই দলের অন্তর্ভুক্ত। এদের দেহে লোম থাকে, বাচ্চা মায়ের দুধ খেয়ে বড়ো হয়, মায়েরা বাচ্চা প্রসব করে। স্তন্যপায়ী প্রাণী মাছ, ব্যাঙ, সাপ, পাখি ইত্যাদি থেকে বুদ্ধিমান। এদের মস্তিষ্ক ও দেহের গঠন বেশ উন্নত।
নিচের ছকটি তোমার বিজ্ঞানের খাতায় এঁকে নিয়ে পূরণ কর। প্রতিটি প্রাণীর নিচে তিনটি বৈশিষ্ট্যের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দাও। যেমন: রুই মাছে আঁইশ আছে। তাই রুই মাছের কলামে আঁইশের জায়গায় টিক (✔) চিহ্ন দাও।
| কাক | রুই মাছ | টিকটিকি | সোনা ব্যাঙ | ইলিশ মাছ | কুকুর | মুরগি | সাপ | ছাগল | কুনো ব্যাঙ |
দেহ-আবরক লোম আছে |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
উপাঙ্গসমূহ ডানা আছে |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
মুখ-গহ্বর |
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
এই অধ্যায়ে আমরা যা শিখলাম
- জীব নড়াচড়া করে, পুষ্টি, প্রজনন, শ্বসন, অনুভূতি, অভিযোজন, বৃদ্ধি ও রেচন হয়।
- জীবজগতের পাঁচটি রাজ্য, যথা- মনেরা, প্রোটিস্টা, ফানজাই বা ছত্রাক, উদ্ভিদ ও প্রাণী।
- অপুষ্পক উদ্ভিদ যেমন- সমাঙ্গ উদ্ভিদ, মস ও ফার্ন।
- সপুষ্পক উদ্ভিদ যেমন- নগ্নবীজী ও আবৃতবীজী।
Read more